মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৫





                            উপন্যাস : প্রবাসের কান্না


                    


                     মা যে আমার কত প্রিয়, ভাষা দিয়ে বুঝাতে পারব না। পৃথিবীর সব একদিকে, শুধু মা

আরেকদিকে ; মায়ের পাল্লাই বেশি ভারী । সন্তান -সন্ততি, ভাই- বোন,স্ত্রী-স্বজন সবার চেয়ে বেশি 

অধিকার  মায়েরই প্রাপ্য। সেজন্য পৃথিবীতে মায়ের তুলনা মা নিজেই, অন্য কেউ নয়।  সন্তান অনেক

দূরে খুব বিপদে পড়লে মায়ের অন্তরে খবর হয়ে যায়। মা ও সন্তানের মাঝে অলৌকিক একটি সুতার

বন্ধন রয়েছে। দূর দেশে সন্তানের বিপদে শত -সহস্র মাইল দূরে থাকলেও মায়ের চক্ষু অশ্রুতে ভরে

যায়। মা শুধু হাহাকার করতে থাকেন। পরে ঠিকই মায়ের কাছে সন্তানের বিপদের সংবাদ পৌঁছে

যায়। পৃথিবীতে প্রত্যেক লোকের এমন মমতাময়ী মানুষ একজনই ;তিনি হচ্ছেন মা, শুধুমাত্র মা, জন্ম

দাত্রী মা ।


            সন্তান প্রসবের আগে  প্রত্যেক মা সন্তানকে প্রায় চল্লিশ সপ্তাহ গর্ভে ধারণ করে রাখেন।

প্রসবের শেষের মাসে মা প্রায় তিন কেজি ওজনের বাচ্চাটিকে প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে বহন করে থাকেন।

প্রত্যেক সেকেন্ডে সেকেন্ডে এত বেশি ওজন ধরে রাখা যে কত কষ্টের, একমাত্র মমতাময়ী মা ছাড়া

পৃথিবীতে সেটি কেউ বুঝে না। গর্ভাবস্থায় বমি, বমি-বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা, পেটে ব্যথার যন্ত্রণা ইত্যাদি

তো প্রতিটি মায়ের কাছে অসহনীয়। গর্ভধারণের কষ্ট কি কোনদিন কোন পুরূষ কখনো বুঝে ? হৃদয়ে

অনুভব করে ?

              সন্তান জন্মকালীন ব্যথা জলন্ত অঙ্গারে জ্বলার সমতুল্য।মা যে ঐসময় কত হ্রদয়বিদারক 

ক্রন্দন করেন,  কোন বাবা কি তা স্বচক্ষে দেখেন? দেখেন কেবল ধাত্রী, নার্স আর ডাক্তার । সন্তান

যদি কোনভাবে নিজের জন্মকালীন আপন মায়ের অসহ্য বেদনা আপন চক্ষে দেখতে পেত, তাহলে

কোন সন্তান কোন দিন আপন মায়ের সঙ্গে দূর্ব্যবহার করত না। 


এমন অনেক মা আছেন আমাদের সমাজে,  যাঁরা সন্তানের দেওয়া কষ্ট সহ্য না করতে পেরে ক্রন্দন 

করেন। ঐ সন্তানের দূর্ভাগ্য, যে সন্তান মায়ের মর্যাদা উপলব্ধি করে না। ছোট বেলায় স্কুলের 

পাঠ্যসূচিতে পড়ে জেনেছি, বায়েজিদ বোস্তামী (র) জগৎ বিখ্যাত আল্লাহর ওলী হয়েছিলেন মায়ের

দোয়ার বরকতে । তাঁর মা একরাতে গভীর রজনীতে ঘুম থেকে জেগে গিয়েছিলেন পানির পিপাসায়।

ঘুম থেকে জেগেই তাঁর মা বললেন,

বাবা, মাকে এক গ্লাস পানি দাও।

ছোট্র শিশু বায়েজিদ তখন কলসির কাছে গিয়ে দেখলেন, কলসি শূন্য। তখন বায়েজিদ ভাবলেন, 

আমার মা পানি চেয়েছেন ; তাকেঁ যেভাবেই হোক পানি দিতেই হবে । এই ছোট্র শিশুটি তখন অন্তরে

মাতৃ ভালবাসা অনুভব করলেন। ছুটে চললেন এক ক্রোশ দূরে পানি আনার জন্য, গভীর রজনীতে 

সমস্ত ভয় -ভীতি উপেক্ষা করে। পানি এনে গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে দেখলেন,

তাঁর মা ঘুমিয়ে  পড়েছেন।

 বায়েজিদ ভাবলেন, ঘুম থেকে জাগালে মা কষ্ট পাবেন। বায়েজিদ পানি নিয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। 

ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েই রইলেন ; পায়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকলেন । মাঝ রাতের পর শেষ

রাতও পার হল ;এরপর সুবেহ সাদিক ও শেষ হল। অবশেষে মুয়াযযিনের সুমধুর ধ্বনি মায়ের

কর্ণকুহরে ভেসে আসল। মা আঁখি খুলেই দেখলেন,

পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে বায়েজিদ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মা বললেন ,

বাবা,  তুমি সারারাত ঘুমাও নাই ?

বায়েজিদ বললেন , মা, তোমার যদি পানির পিপাসায় কষ্ট হয়, এজন্য সারারাত ঘুমাই নাই।

এরপর মুখ ধূয়ে তাঁর মা পানি খেলেন। তারপর ওযূ করে ফযরের নামায পড়ে দুই হাত তুলে 

আকাশের দিকে তাকিয়ে  তাঁর মা দু'আ করললেন,

রাব্বুল আলামিন, আমি বায়েজিদের মা ; বায়েজিদ আমার সন্তান ; মা হয়ে আমি সন্তানের জন্য

দু'আ করি; আমার বায়েজিদ আজ রাতে আমার জন্য যা করল,তুমি দেখেছ, আমার মন প্রশান্তিতে

ভরে গেছে ;আমি দু'আ করি, তুমি আমার বায়েজিদকে তোমার প্রিয় পরহেযগার লোকদের নেতা 

বানিয়ে দাও ; তোমার রাসূল (স) বলেছেন,

সন্তানের জন্য মায়ের দু'আ এবং আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই। তুমি তিন ব্যক্তির দু'আ সরাসরি

কবুল করে নেও, এর মধ্যে এক ব্যক্তি হল, সন্তানের জন্য মায়ের দু'আ।

আয় আল্লাহ, বায়েজিদ আমার জন্য যা করেছে, আমার মন খুশিতে ভরে গেছে ; তুমি আমার 

বায়েজিদকে তোমার প্রিয় পরহেযগার লোকদের নেতা বানিয়ে দাও। আমিন !!!!!!

এরপর ধীরে ধীরে বায়েজিদ বোস্তামী (র) জগৎ বিখ্যাত আল্লাহর ওলী হয়ে গেলেন। এভাবে কেউ 

যদি মায়ের মন জয় করতে পারে, তাহলে সে মায়ের দু'আর বরকতে দুনিয়া ও আখেরাতের অনেক

বড়, অনেক কিছু পাবে । সর্বত্র তার জীবন সুখ- শান্তিময় হবে। 


           আমার মায়ের কথা আমার আজ অনেক মনে পড়ছে। আমি তাঁকে খুবই মিস করছি। গতরাতে

খাবার আগে  আমার যেন মনে হচ্ছিল, মা আমাকে ডেকে বলছেন,
       বাবা, তাড়াতাড়ি খেতে আয় ; খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে , পরে খেতে মজা লাগবে না।

এসময় আমার স্বদেশি আরিফ ভাই আমাকে হঠাৎ দেখে বললেন, কিরে হাসান, কাঁদিস না, 

এভাবে কাঁদলে বিদেশে থাকবি কেমনে ? এত দূর প্রবাসে থেকে উপার্জন তো তোর পরিবারের

জন্যই। মন শক্ত কর্ । এভাবেই বিদেশে আমাদের এক সপ্তাহ কাটে ,  কাটে এক মাস, ছয় মাস, 

কারো কারো বছরের পর বছর ।